সারাদেশ ডেস্ক
প্রকাশ : সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:১৭ অপরাহ্ণ
অনলাইন সংস্করণ

নদীমাতৃক গ্রামজীবন থেকে পালতোলা নৌকার বিদায়

নদীমাতৃক গ্রামজীবন থেকে পালতোলা নৌকার বিদায়

নদীমাতৃক বাংলাদেশের গ্রামজীবনকে একসময় পথ দেখাত নদী আর নৌকা। এই নৌকাই ছিল মানুষের আদি বাহন, জীবিকা ও যাতায়াতের প্রধান ভরসা। নদী ছিল জীবনের ছন্দ, আর সেই ছন্দের রঙিন পর্দা ছিল পালতোলা নৌকা। যে নৌকা বাতাসে পালে দোলা দিয়ে ছুটে যেত—মানুষের হৃদয়ে আনন্দ, স্বপ্ন আর সুরের ঢেউ তুলত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আবহমান সেই লোকজ সৌন্দর্য আজ বিলীন হওয়ার পথে। গাইবান্ধার পূর্বদিকে ছোট যমুনা নদীবেষ্টিত কামার জানি ও হরিপুর এলাকার, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীতে একসময় নদীর বুক ভরে ছিল সারি সারি পালতোলা নৌকায়। পদ্মা, যমুনা, তিস্তা ব্রহ্মপুত্র সহ দেশের নানা নদীতে রঙিন পাল উড়িয়ে ছুটে চলত শত শত নৌকা। স্বচ্ছ জলে পালের ছায়া, বাতাসে পাল ধরে পতপত শব্দ, মাঝির দরাজ কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান —সব মিলিয়ে নদীর বুকে তৈরি হতো অপার শান্তির মায়াবী মঞ্চ। পনেরো বিশ বছর আগেও নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে দূর থেকে পালের নৌকার ছন্দবদ্ধ চলা দেখলে মন নেচে উঠত। মাঝনদী থেকে ভেসে আসা ভাটিয়ালির সুর গ্রামবাসীর মন কাড়ত প্রতিদিন।

গাইবান্ধা জেলার সাতটি উপজেলাজুড়ে ছোট-বড় শতাধিক নদী। ঘাঘট, তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র—সব নদীর বুকে একসময় ছিল পালতোলা সাম্পান, গয়না, কোষা, পেটকাটা নাও, বোঁচা নাওসহ হরেক রকমের নৌকা। ৯০-এর দশক পর্যন্ত বড় বড় পালতোলা নৌকা পাট, ধান ও চাল নিয়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে যাতায়াত করত। তখন ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছিল হাতে গোনা; বাতাসের শক্তিতেই পাল তুলে নৌকা ছুটে যেত। কামারজানী নৌবন্দর এলাকায় মাছের ঘাটপাড়ের এক চায়ের দোকানে দেখা মিলল প্রায় ৭৫ বছর বয়সী নৌকা মাঝি জমসের হাওয়ালদারের। তার মুখে শুনতে পেলাম বিলুপ্তির বেদনাময় গল্প—

“এখন তো আধুনিক যুগ। স্যালো–ইঞ্জিন নৌকার দাপট। আমরা একসময় পাল তুলে নৌকা চালাতাম। ধান, চাল, পাট—সব নিয়ে দূরে যেতাম। নৌকায় বসে ভাটিয়ালি গাইতাম, নদী ছিল আমাদের ঘর। সেই আনন্দের দিনগুলা এখন আর নাই। নদীতে পালতোলা নৌকাই আর চোখে পড়ে না।” তার কণ্ঠে সেই দীর্ঘশ্বাস যেন সময়ের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে জাগিয়ে তোলে।

অভিমানে যেন নদীগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। আষাঢ়-শ্রাবণ ছাড়া পানি নেই বললেই চলে। তখন যে কয়টি নৌকা চলে—সেগুলোও ইঞ্জিনচালিত। রঙিন পালের নৌকা আজ স্মৃতি, গল্প আর ছবির অ্যালবামে সাজানো ইতিহাস। পালতোলা নৌকা শুধু যানবাহন ছিল না—এ ছিল এক বিশাল লোকসংস্কৃতি, ছিল বাংলার গ্রামজীবনের প্রাণ। মাঝিদের ভাটিয়ালি, মানুষকে নদীর ওপাড়-এপাড়ে পৌঁছে দেওয়ার দৃপ্ত সময়, আর বাতাসে দুলতে থাকা পালের রঙ্গে রঙ্গে সাজানো জীবন—সবই আজ হারিয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক সভ্যতার অতলে।

শেষ কথা আজ নদীর ধারে দাঁড়ালে সেই রঙিন পালের সমারোহ আর দেখা যায় না। চোখে পড়ে শুধু নীরবতা, যান্ত্রিকতার শব্দ, আর স্মৃতির ঢেউ। তবু যারা সেই সময় দেখেছেন—তারা জানেন, পালতোলা নৌকার অপার্থিব সৌন্দর্য আর আনন্দের তুলনা নেই। বাংলার এই ঐতিহ্য ছিল এক ধরনের শিল্প, এক ধরনের জীবন—যা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সময়ের স্রোতে। এখন আর পালতোলা নৌকা চোখে পড়ে না—এ যেন পুরো নদীমাতৃক বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া শ্বাস।

লেখক: সরকার শাহাদত হোসেন
সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গাজা ইস্যুতে জাতিসংঘে ট্রাম্পের প্রস্তাব পাস, প্রত্যাখ্যান হ

1

৪০ নেতার পদ ফিরিয়ে দিল বিএনপি

2

টেকনাফে ৩ মানবপাচারকারী আটক, উদ্ধার নারী-শিশুসহ ৭ জন

3

হাসিনা ও কামালকে ফেরাতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার: আ

4

যথেষ্ট ধনী হলে সৌদী আরবেও মিলবে মদ

5

মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেবে গণতন্ত্রকামী ম

6

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো আশঙ্কা নেই : ইসি সানাউল্ল

7

ফজলুর রহমানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দে

8

পঞ্চগড়ের বোদায় বিডি ক্লিনের পরিচ্ছন্নতা ইভেন্ট অনুষ্ঠিত

9

পেছানো হচ্ছে পাকিস্তানের বাংলাদেশ সফর

10

কিশোরগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন বাতিল ও পুনর্বিবেচনার দাবিতে

11

ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত; দ্বিরাষ্ট্র গঠনই সমাধানের একমাত্র পথ

12

হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের সঙ্গে প্রিন্স সালমানের বৈঠক ১৮ নভেম্ব

13

জেন-জি'র নেতৃত্বে মেক্সিকোতে বিশাল বিক্ষোভ

14

হংকংয়ে আবাসিক ভবনে ভয়াবহ আগুনে নিহত ৪৪, নিখোঁজ ২৭৯

15

‘মেয়েদের জীবনের থেকে একটা ওড়না বেশি গুরুত্বপূর্ণ’

16

শিক্ষক কর্তৃক হিজাব পরিহাস: ফেনী কলেজে তদন্ত কমিটি গঠন

17

তফশিল ঘোষণার সময় জানালেন ইসি মাসউদ

18

রিকশাচালকদের জন্য শায়খ আহমাদুল্লাহর নতুন উদ্যোগ

19

হোয়াইট হাউসের কাছে গুলি, গুরুতর আহত ২ সেনা

20
সর্বশেষ সব খবর