বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের চার-পাঁচজন উপদেষ্টা একটি নির্দিষ্ট দলের হয়ে কাজ করছে। তাদের বিভিন্ন অপকর্ম ও অনৈতিক কার্যকলাপের প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। তারা যদি নিজেদের সংশোধন না করে, তাহলে আমি নিজেই তাদের নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনগণ যদি জানতে পারে, তারা জুলাইয়ের চেতনার সঙ্গে বেইমানি করছে, তাহলে তাদের পরিণতি হবে পতিত ফ্যাসিবাদের চেয়েও ভয়াবহ।’ গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মৎস্য ভবন মোড়ে আয়োজিত এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত এই মানববন্ধনের মূল দাবি ছিল জুলাই সনদের আইনি স্বীকৃতি, পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন, এবং জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের বিচারের দাবি।
ডা. তাহের অভিযোগ করেন, ‘সরকারের ভেতরে একটি বিশেষ গোষ্ঠী নীলনকশার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন যদি হয়, জনগণ তা কোনোভাবেই মেনে নেবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম ফ্যাসিবাদের পতনের পর রাজপথে আর নামতে হবে না। কিন্তু এখন আবার দেখা যাচ্ছে, একটি দল জুলাই সনদকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করছে। তারা এর চেতনাকে গ্রহণ করতে চায় না। বরং প্রশাসনকে দলীয়করণ করে নিজেদের সুবিধামতো নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করছে।’
প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে ডা. তাহের বলেন, ‘আপনি একজন সৎ ও ভালো মানুষ। অনেকে বলে আপনি সরল, প্যাঁচ বোঝেন না। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার চারপাশে এমন কিছু লোক আছে যারা আপনাকে ব্যবহার করছে, বিভ্রান্ত করছে। এখনই যদি তাদের সরিয়ে না দেন, জনগণই তাদের সরিয়ে দেবে।’ তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, ‘হাসিনা ১৬ বছর টিকে থাকতে পেরেছিল, কারণ তার চারপাশে একদল অন্ধ সমর্থক ছিল। কিন্তু আপনাদের অবস্থা তেমন নয়। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে কয়েক মিনিটও টিকতে পারবেন না।’
ডা. তাহের বিএনপির দিকেও ইঙ্গিত করে বলেন, ‘একটি দল মুখে সংস্কারের কথা বললেও, বাস্তবে ঐকমত্য কমিশনে প্যাঁচ লাগিয়ে সংস্কার বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে। আমরা তাদের বলবো, সংলাপে বসুন, নচেৎ জনগণই রাস্তায় নামবে।’
তিনি গণভোটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় বিএনপিকে ধন্যবাদ জানালেও অভিযোগ করেন, ‘তারা কৌশল করছে। তারা বলছে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে করতে হবে। কিন্তু এটি বাস্তবসম্মত নয়। দুটি ভোট একদিনে হলে নানা জটিলতা সৃষ্টি হবে।’
জামায়াত নেতা বলেন, ‘বাংলাদেশে দুটি গণভোট ২১ ও ১৭ দিনের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাই আগামী নভেম্বরের ১৫ তারিখে গণভোট আয়োজন করা সম্ভব। এটিকে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবেও দেখা যেতে পারে। আমরা মনে করি, এটি সরকারের সক্ষমতা যাচাইয়ের একটি টেস্ট হতে পারে।’ তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘জনগণের যৌক্তিক দাবি মেনে নিতে হবে। দাবি আদায়ের জন্য যা যা প্রয়োজন, আমরা করবো।’ ডা. তাহেরের বক্তব্যে আরও উঠে আসে, ‘দেশে যারা ফ্যাসিবাদ, লুটপাট ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল অতীতে যেমন অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে ছিল, এখনো তেমন চেষ্টা করছে। জনগণ এবার তাদের আর সুযোগ দেবে না।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাছুম বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করার পরই জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। সরকার এখন একপক্ষীয় হয়ে পড়েছে, ভারসাম্য হারিয়েছে। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিগত দিনের খুনি, লুটেরা, ও অর্থপাচারকারীদের বিচার করতে হবে। জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলও এদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে যদি প্রয়োজনীয় সংস্কার না হয়, তবে জনগণ সেই নির্বাচনে অংশ নেবে না।’
অন্যদিকে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের বলেন, ‘৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় রচিত হয়েছে। এদিনে ১ হাজার ৪০০ মানুষ শহীদ হয়েছেন। তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পরিবর্তনকে সংরক্ষণ করতে হলে সরকারকে সংস্কার ও বিচার সংক্রান্ত ৫টি মৌলিক দাবি মানতে হবে। দেশে আর কোনো দিন ফ্যাসিবাদের জায়গা হবে না।’
জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে গাবতলী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতারাও এতে বক্তব্য রাখেন। মহানগর দক্ষিণের সভাপতি নুরুল ইসলাম বুলবুল ও উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম মানববন্ধনের সমন্বয় করেন। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি ইয়াছিন আরাফাত এবং দক্ষিণের নায়েবে আমির ড. হেলাল উদ্দিন। জামায়াতের পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ আরও সাতটি রাজনৈতিক দল একই দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে সমাবেশ করেছে বলে জানানো হয়।
ডা. তাহেরের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বর্তমান সরকারের নির্বাচন প্রক্রিয়া, উপদেষ্টাদের ভূমিকা এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি সরকারের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘যারা জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন করা হবে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই বক্তব্য কেবল সরকারের প্রতি চাপ বাড়াবে না, বরং দেশের আগামী নির্বাচন ও গণভোটের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
সকালবেলা/এমএইচ