বাংলাদেশে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সড়ক, রেল ও নৌপথে সংঘটিত দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জন নিহত এবং ৯৮২ জন আহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং নিহত ও আহতের পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক এবং দেশের সড়ক নিরাপত্তার জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শুধুমাত্র সেপ্টেম্বর মাসে রেলপথে ৫০টি দুর্ঘটনায় ৪৬ জন নিহত ও ৩ জন আহত হয়েছেন। নৌপথে ১৩টি দুর্ঘটনায় নিহত ১৭ জন, আহত ১৫ জন এবং ৩ জন নিখোঁজ রয়েছেন। সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে মোট ৫৬৭টি দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জন নিহত এবং ৯৮২ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ১৯১টি, যেখানে ১৯৯ জন নিহত এবং ১৮৮ জন আহত হয়েছেন। মোট দুর্ঘটনার মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার অংশগ্রহণ ৩৭.৮৯ শতাংশ, নিহতের ৩৯.৬৪ শতাংশ এবং আহতের ১৯.৫০ শতাংশ।
সেপ্টেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে, যেখানে ১২৬টি দুর্ঘটনায় ১২২ জন নিহত এবং ২১৬ জন আহত হয়েছেন। অপরদিকে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা হয়েছে বরিশাল বিভাগে, যেখানে ২২টি দুর্ঘটনায় ২৭ জন নিহত ও ৪৭ জন আহত হয়েছেন। এই তথ্য বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের মাধ্যমে গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণে পাওয়া গেছে। দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে ৯ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ১৩৩ জন চালক, ১০৬ জন পথচারী, ২৬ জন পরিবহন শ্রমিক, ৬৫ জন শিক্ষার্থী, ৮ জন শিক্ষক, ৮৮ জন নারী, ৫৪ জন শিশু, ২ জন মুক্তিযোদ্ধা, ১ জন আইনজীবী, ১ জন সাংবাদিক এবং ১ জন চিকিৎসক। এছাড়া ১২ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীও আহত হয়েছেন।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে ৫ জন পুলিশ সদস্য, ১ জন সেনা সদস্য, ১ জন মুক্তিযোদ্ধা, ১ জন আইনজীবী, ১ জন চিকিৎসক, ১২৬ জন বিভিন্ন পরিবহনের চালক, ১০২ জন পথচারী, ৬৭ জন নারী, ৪৯ জন শিশু, ৫৬ জন শিক্ষার্থী, ৮ জন পরিবহন শ্রমিক, ৮ জন শিক্ষক এবং ৭ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। দুর্ঘটনায় জড়িত ৭৭২টি যানবাহনের বিশদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দুর্ঘটনার মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ২৯.১ শতাংশ, ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান ও লরির সংখ্যা ২২.২ শতাংশ, বাস ১৬.৫৮ শতাংশ, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক ১২.১৭ শতাংশ, সিএনজি চালিত অটোরিকশা ৭.৩৮ শতাংশ এবং নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা-ট্রাক্টর ও লেগুনা ৭.২৫ শতাংশ। এছাড়া কার-জিপ-মাইক্রোবাসের সংখ্যা দুর্ঘটনায় ৫.৫৬ শতাংশ।
মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “দেশে সড়ক নিরাপত্তা এখনো অনেক পিছিয়ে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যানবাহনের মান, অবৈধ যাত্রী পরিবহন, অতিরিক্ত গতি, দুর্ঘটনা পরবর্তী প্রাথমিক চিকিৎসার অভাব এবং আইনশৃঙ্খলার অভাব গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধি, চালক ও পথচারীর প্রশিক্ষণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারি এবং যানবাহনের নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা অপরিহার্য। তিনি বলেন, ‘মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হওয়ায় এর প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি। হেলমেট ব্যবহারের নিশ্চয়তা, সড়ক চিহ্ন এবং লেইন নিয়ম মেনে চলা, যাত্রী ও চালকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’ দুর্ঘটনার পরিণতি শুধুমাত্র পরিবার নয়, পুরো সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নিহত ও আহতদের পারিবারিক জীবনে অস্থিরতা, মানসিক চাপ এবং আর্থিক ক্ষতি তৈরি হয়। এছাড়া দুর্ঘটনার কারণে স্বাস্থ্য খাতে চাপ বেড়ে যায় এবং জরুরি পরিষেবা ব্যবস্থা অপ্রতুল হয়ে পড়ে।
মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরও বলেন, ‘যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে সরকারের সাথে সমন্বয় করে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে। জরুরি ব্যবস্থাপনা, সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইন প্রয়োগ একসাথে করতে হবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, ‘প্রতিটি দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমরা সুপারিশমূলক পদক্ষেপ প্রণয়ন করতে পারব। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হলে শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা নয়, নাগরিক সচেতনতা ও কার্যকর ব্যবস্থা অপরিহার্য।’
সমিতির তথ্যানুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসের এই পরিসংখ্যান পূর্বের মাসের তুলনায় আরও উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সড়ক দুর্ঘটনার হার কমাতে জোরদার আইন প্রয়োগ, শিক্ষামূলক প্রচারণা, যানবাহনের মানোন্নয়ন এবং সড়ক অবকাঠামো উন্নত করার প্রয়োজন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ‘যাত্রী ও চালক উভয়কেই সচেতন করা হলে দুর্ঘটনার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। পাশাপাশি দুর্ঘটনার পর জরুরি সেবা, হাসপাতাল ও রেসকিউ ব্যবস্থার উন্নয়নও অপরিহার্য।’
সকালবেলা/এমএইচ