বাংলাদেশ আজ কৃষি উৎপাদনে গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য অর্জন করেছে। ধান, গম ও সবজির উৎপাদন গত দশকে ব্যাপক হারে বেড়েছে, যা কৃষকদের কঠোর পরিশ্রম, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও সরকারি সহায়তার ফল। তবে এই প্রাচুর্যের মাঝেও দেশের প্রায় ১৬ মিলিয়ন মানুষ খাদ্যের অভাবে প্রশ্নবিদ্ধ জীবনযাপন করছে, যা দুঃখের বিষয়। পাশাপাশি, প্রতি বছর মাথাপিছু প্রায় ৮২ কেজি খাদ্য অপচয় হচ্ছে। এই বৈপরীত্য আমাদের সচেতনতার ঘাটতি ও দুর্বল নীতিনির্ধারণের প্রমাণ।
খাদ্য অপচয় বেশি দেখা যায় গৃহস্থালি পর্যায়ে, সামাজিক আয়োজন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও বাজারজাতকরণের সময়ে। ফলমূল ও সবজির সঠিক সংরক্ষণ না হওয়ায় সাধারণত খাবার পচনের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে, অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার ফলেও খাদ্য প্রচণ্ড পরিমাণে নষ্ট হয়। এর সঙ্গে জল, বিদ্যুৎ, শ্রম ও সময়ের অপচয়ও যুক্ত থাকে। একদিকে কৃষক তাদের উৎপাদনের যথাযথ মূল্য পাচ্ছেন না, অন্যদিকে দরিদ্র মানুষের জন্য খাবারে সংকট তৈরি হচ্ছে — যা স্পষ্ট সামাজিক বৈষম্যের সংকেত।
অর্থনৈতিক ক্ষতিও ভয়াবহ। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, খাদ্য অপচয়ের কারণে বাংলাদেশ বছরে কোটি কোটি টাকার অর্থনীতিগত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এছাড়া, খাদ্য অপচয় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বাড়িয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিও বৃদ্ধি করে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।
এ সংকট প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যুগোপযোগী কর্মসূচি নিতে হবে। উৎপাদন থেকে ভোগ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে খাদ্যের সংরক্ষণ ও পরিবহন সুসংহত হয়। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি—খাবার অপচয় না করার নৈতিকতা গড়ে তুলতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো যেতে পারে।
বড় ইভেন্ট বা রেস্টুরেন্টে অব্যবহৃত খাবার দরিদ্রদের মাঝে বিতরণের জন্য ‘ফুড ব্যাংক’ বা ‘খাদ্য পুনর্ব্যবহার’ কার্যক্রম অবিলম্বে চালু করা আবশ্যক। বিশ্বজুড়ে এ ধরনের উদ্যোগ সাফল্যের নজির দেখিয়েছে, তাই স্থানীয় প্রশাসন ও এনজিও’দের সমন্বয়ে বাংলাদেশেও এ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন সম্ভব।
খাদ্য অপচয় রোধ শুধু খাদ্য রক্ষা নয়, এটি মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক দায়বদ্ধতার পরিচায়ক এবং টেকসই উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যদি এই বিষয়কে জাতীয় অগ্রাধিকারে রাখি, তবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারব।