ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নতুন নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করেছে এমন এক সময়ে, যখন প্রতিষ্ঠানটি তীব্র বাজেট ঘাটতি ও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে। তবুও নবনির্বাচিত এই কমিটি কল্যাণমূলক, অবকাঠামোগত ও শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
নিজেদের ৩৬ দফা প্রতিশ্রুতি পূরণে ডাকসু এখন ‘বহিরাগত পৃষ্ঠপোষকতা’ মডেলের ওপর নির্ভর করছে। ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ নেতৃত্বাধীন নতুন ডাকসু কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই কার্যত ‘শূন্য ব্যালেন্সে’ কাজ শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এখন পর্যন্ত ডাকসুকে কোনো আর্থিক সহায়তা বা বাজেট বরাদ্দ দেয়নি। ফলে নতুন নেতৃত্বকে শুরু থেকেই ব্যক্তিগত খরচ ও সীমিত সম্পদ দিয়ে কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে।
ডাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) আবু সাদিক কায়েম বলেন, ‘ডাকসু দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিল, তাই শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। প্রথম মাসে কাঠামো গঠন, পরিকল্পনা তৈরি ও অগ্রাধিকার নির্ধারণেই সময় গেছে।’ তিনি আরও জানান, এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো প্রশাসনিক বা কার্যক্রমভিত্তিক ব্যয় বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। এজন্যই তারা প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বহিরাগত দাতাদের সহযোগিতা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এস এম ফারহাদ বলেন, ‘আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত অর্থে যাতায়াত, অতিথি আপ্যায়নসহ দৈনন্দিন খরচ বহন করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে এখনো কোনো ফান্ড পাইনি।’ ভিপি কায়েম জানান, ডাকসু ইতোমধ্যে কোশাধ্যক্ষের দফতরে দুটি আনুষ্ঠানিক আবেদন দিয়েছে। এতে ১৯৯০ সাল থেকে সংগৃহীত ছাত্র ফি’র হিসাব, ২০১৯ সালের অডিট রিপোর্ট ও ২০২৪ সাল পর্যন্ত ছাত্রদের বার্ষিক ৬০ টাকার ফি’র ব্যয় বিবরণী চাওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দের পরিকল্পনা আছে, তবে সেটি কেবল ডাকসু ভবন সংস্কারের জন্য, কার্যক্রমের জন্য নয়। ফলে প্রশাসনিক সহায়তা না পাওয়ায় ডাকসু বহিরাগত পৃষ্ঠপোষক মডেল গ্রহণ করেছে।
জিএস ফারহাদ বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠান পৃষ্ঠপোষকতা দিতে আগ্রহী, তাদের নামেই প্রকল্প হবে। তারা সরাসরি অর্থ প্রদান করবে, আমাদের হাতে টাকা থাকবে না। এতে স্বচ্ছতা বজায় থাকবে।’ এই মডেলটি ইতোমধ্যে কয়েকটি বড় প্রকল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে : যেমন ৩০ লাখ টাকার ছারপোকা নিধন অভিযান এবং মেয়েদের হলে ১ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে এসি স্থাপন প্রকল্প।
প্রথম পর্যায়ে ডাকসু অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও বাসস্থানসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে মনোযোগ দিয়েছে। ভিপি সাদিক কায়েম জানান, ‘ডাকসু ভবনের সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা টয়লেট, নতুন টাইলস ও পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থার উন্নয়ন চলছে।’ এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, শিক্ষক, কর্মচারী ও হল কাউন্সিলের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি সমন্বিত প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। দলীয় রাজনীতিতে জড়িতদের ডাকসু অফিস থেকে অপসারণ এবং নিরাপত্তাকর্মীদের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
ডাকসু এখন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে : বাস ট্র্যাকিং অ্যাপ : শিক্ষার্থীদের নিরাপদ যাতায়াতের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে, এক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হবে। শাটল সার্ভিস বৃদ্ধি : বিভিন্ন রুটে শিক্ষার্থীদের চলাচল সহজ করতে নতুন বাস যুক্ত হচ্ছে। চিকিৎসা সেবা : ইবনে সিনা মেডিক্যাল ট্রাস্টের সহযোগিতায় মেডিক্যাল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়েছে; শিক্ষার্থীরা হাসপাতাল সেবায় ৫০% ছাড় পাচ্ছেন। ছারপোকা নিধন কার্যক্রম : জিয়া হলে শুরু হয়েছে; ধীরে ধীরে ১৮টি হলে সম্প্রসারিত হবে। অভিভাবক লাউঞ্জ ও ডে-কেয়ার সেন্টার : নতুনভাবে স্থাপন প্রক্রিয়া চলছে। খাবারের মান নিয়ন্ত্রণে ডাকসু কয়েকটি হলে ‘সেফ ফুড ট্রায়াল প্রোগ্রাম’ শুরু করেছে। নিম্নমানের খাবার সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ডাকসু একটি সাংস্কৃতিক ক্যালেন্ডার তৈরির কাজ করছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংহতি জোরদারে ‘গ্লোবাল সলিডারিটি হাব’ গড়ে তোলা হচ্ছে, যা ফিলিস্তিনসহ নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতি সংহতি জানাবে। প্রতি মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহযোগিতায় ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থী কল্যাণ, নিরাপত্তা এবং অবকাঠামো উন্নয়নকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু বড় উদ্যোগ : ১. আবাসন সমস্যা সমাধান : প্রশাসনকে চাপ দেওয়া হবে ২,৮৪১ কোটি টাকার চারটি নতুন হল নির্মাণের কাজ দ্রুত শুরু করতে। অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য বাসস্থান ভাতা চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ২. মেডিক্যাল সেন্টার আধুনিকায়ন : আগামী মাসেই নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপন ও পূর্ণাঙ্গ সেবা চালুর পরিকল্পনা। ৩. নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা : ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও মুখমণ্ডল শনাক্তকরণভিত্তিক সিকিউরিটি বক্স সিস্টেম চালুর কাজ চলছে। ৪. কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন: প্রতিটি হলে কম্পিউটার ল্যাব চালুর উদ্যোগ; আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজন করা হবে। ৫. শিক্ষা-প্রযুক্তি সুবিধা : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য টার্নইটইন, রিসার্চ জার্নাল ও প্রিমিয়াম সফটওয়্যারে বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার নিশ্চিতের চেষ্টা চলছে। ৬. ফার্স্ট এইড প্রশিক্ষণ ও পরিচ্ছন্নতা : প্রতিটি হলে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ এবং নিয়মিত ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা হবে। ৭. নারী শিক্ষার্থীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত : ডাকসু ইতোমধ্যে এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন দাখিল করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ডাকসু কমিটি তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও দৃঢ়তা ও উদ্ভাবনী চিন্তার পরিচয় দিয়েছে। বহিরাগত পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি এটি নতুন এক স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ মডেলের সূচনাও হতে পারে। যদি প্রশাসন ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পূর্ণ সহায়তা মেলে, তবে এই ডাকসু মডেলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন, শিক্ষার্থী কল্যাণ এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের এক নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।
সকালবেলা/এমএইচ