মুহাম্মাদ মুহসিন: বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘদিনের পরিচিত ছকটি ৫ আগস্টের পর আমূল বদলে গেছে। গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে যে দ্বিমেরুর রাজনীতি বা ‘আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি’র সমীকরণ আমরা দেখে এসেছি, তা আজ কার্যত ভেঙে পড়েছে। মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ নেই, জাতীয় পার্টিও অস্তিত্ব সংকটে কোণঠাসা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে মাঠ এখন একচ্ছত্রভাবে বিএনপির দখলে; কিন্তু দৃশ্যপটের গভীরে তাকালে দেখা যায় ভিন্ন এক বাস্তবতা।
৫ আগস্টের বিজয়ের পর বিএনপির সামনে সুবর্ণ সুযোগ ছিল নিজেদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড, দখলদারিত্ব এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল দলটিকে সাধারণ মানুষের কাছে কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যে প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল, মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন না দেখে অনেকেই হতাশ। ফলে প্রতিনিয়ত বিএনপির ভোট ব্যাংকে ফাটল ধরছে এবং তাদের প্রতি জনসমর্থন দুর্বল হচ্ছে।
রাজনীতিতে শূন্যস্থান বলে কিছু নেই। বিএনপির এই দুর্বলতার সুযোগে এবং আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে মাঠে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর নেতৃত্বে গঠিত ৮ দলীয় জোট। অন্য ছোট দলগুলো বা এনসিপি-র মতো জোটগুলো যেখানে নিবন্ধনের সংকটে কিংবা দেউলিয়াত্বের প্রকাশ ঘটাচ্ছে, সেখানে ৮ দলীয় জোট এগোচ্ছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো তাদের কৌশলগত পরিবর্তন। আগে ইসলামি দলগুলোর প্রার্থীরা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেন। কিন্তু এবার ৮ দলীয় জোট সেই বৃত্ত ভেঙে বের হচ্ছে। তারা দলের কট্টর নেতাদের বাইরে গিয়ে সমাজে গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির (Clean Image) এবং ‘ইমেজফুল’ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ার কৌশল নিয়েছে। এই ‘ক্যান্ডিডেট সিলেকশন’ বা প্রার্থী বাছাইয়ের কৌশলটি তাদের বিজয়ের সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
সাধারণ ভোটারদের মনে দীর্ঘদিনের একটি ধারণা ছিল—ইসলামি দলগুলোকে ভোট দিলে তা সরকার গঠনে কাজে আসে না বা ভোটটি ‘নষ্ট’ হয়। এবারের জোটবদ্ধ রাজনীতি এবং শক্তিশালী সমঝোতা সেই ধারণা বা মিথ ভেঙে দিয়েছে। তাছাড়া, যারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন না আবার বিএনপির বর্তমান কর্মকাণ্ডেও সন্তুষ্ট নন—এমন বিশাল একটি ভোট ব্যাংক এখন ৮ দলীয় জোটের দিকে ঝুঁকছে। এটিই স্বাভাবিক রাজনৈতিক মেরুকরণ।
সুতরাং, আগামী দিনের ভোটের মাঠের মূল লড়াইটি আর দ্বিমুখী নয়, বরং এটি হতে যাচ্ছে বিএনপি বনাম ৮ দলীয় জোটের মধ্যে। নির্বাচন যদি যথাসময়ে এবং সুষ্ঠুভাবে হয়, তবে ফলাফলে বড় ধরনের চমক দেখা যেতে পারে।
তবে শঙ্কার জায়গা একটাই। বিএনপি যদি মনে করে মাঠ ফাঁকা এবং সেই সুযোগে তারা পুরনো কায়দায় ভোট ডাকাতি বা পেশিশক্তির আশ্রয় নেবে, তবে তারা ভুল করবে। কারণ, ৮ দলীয় জোটের শেকড় এখন প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। ভোটকেন্দ্র দখল বা কারচুপির চেষ্টা হলে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
দিনশেষে, দেশের মানুষ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং স্থিতিশীলতা চায়। রাজনীতির এই নতুন সমীকরণে শেষ হাসি কে হাসবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে ৫ আগস্ট যে রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
মন্তব্য করুন