ইসমাঈল আযহার
প্রকাশ : বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৯ অপরাহ্ণ
অনলাইন সংস্করণ

রহস্যময় ফ্লাইটে দক্ষিণ আফ্রিকায় কয়েকশত ফিলিস্তিনি

রহস্যময় ফ্লাইটে দক্ষিণ আফ্রিকায় কয়েকশত ফিলিস্তিনি

ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজা থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া এক সংগঠনের বন্দোবস্তে দক্ষিণ আফ্রিকাগামী ফ্লাইটের প্রতিটি আসনের জন্য ১ হাজার ৬০০ ডলার করে দিতে হবে। অর্থ দিতে হবে আগাম, পাঠাতে হবে একটি ক্রিপ্টো অ্যাকাউন্টে।

কয়েক মাস আগে গাজার আহমেদ শেহাদাকে এক ব্যক্তি ফোন করেন। ফোনে ওই ব্যক্তি বলেন, তিনি একটি মানবাধিকার সংগঠনে কাজ করেন। তিনি আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিমানে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন। 

শেহাদা প্রথমে বিশ্বাস করেননি, ধরেই নেন এটা একটি প্রতারণা। তিনি নিষেধ করে দেন। কিন্তু পরে খোঁজখবর নিয়ে এক ফিলিস্তিনি বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, ওই বন্ধুও এই দলের মাধ্যমে গাজার বাইরে পালিয়ে গেছেন। ৩৭ বছর বয়সি শেহাদা সিদ্ধান্ত নেন তিনিও সুযোগ নেবেন।

শেহাদা অর্থ পাঠান। তারপর শুরু হয় চরম উদ্বেগ ও ভীতিকর এক যাত্রা। প্রথমে শেহাদা, তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে দুটি আলাদা আলাদা বাসে ২৪ ঘণ্টা ভ্রমণ করতে হয়। সে ভ্রমণ পথে যে কোনো সময় ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে নিহত হওয়ার ভয় ছিল।

ভীতসন্ত্রস্ত বাস ভ্রমণ শেষ শেহাদারা চরম উদ্বেগ নিয়ে ইসরাইলি চেকপোস্ট পার হন এবং সেখান থেকে গন্তব্য অজানা এক ফ্লাইটে চেপে বসেন। নানা ঘাট ঘুরে শেষ পর্যন্ত শেহাদারা পৌঁছান দক্ষিণ আফ্রিকায়। এটি এমন একটি দেশ, যেখানে শেহাদারা কখনো যাননি।

শেহাদা বলেন, ‘গাজার পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ যে আপনি এমন ঝুঁকি নিতে বাধ্য হবেন।’

দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার এই ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে বা তাদের কারা নিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো কিছুই জানে না। তারা বিষয়টি সন্দেহজনক হিসেবে বিবেচনা করছে।

শেহাদা নিজে একজন চিকিৎসক। তিনি ২৮ অক্টোবর নিজের পরিবার নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছান। আরও কয়েক শ ফিলিস্তিনিকে নিয়ে সম্প্রতি দুটি বিমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় অবতরণ করেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার এই ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে বা তাদের কারা নিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো কিছুই জানে না। তারা বিষয়টি সন্দেহজনক হিসেবে বিবেচনা করছে।

ফিলিস্তিনিদের পরিবহণ করতে ওই চার্টার্ড ফ্লাইটগুলোর ব্যবস্থা করেছিল আল-মাজদ ইউরোপ নামের একটি সংগঠন। এই দল খুব একটা পরিচিত নয়। তাদের বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কর্মকর্তাদের হাতে তেমন কোনো তথ্য নেই।

দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলা গত সোমবার এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, তাদের ধারণা, এই কর্মকাণ্ডের পেছনে ইসরাইলের হাত রয়েছে।
লামোলা একে গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা হিসেবে বর্ণনা করেন।

তবে ইসরাইল দক্ষিণ আফ্রিকার মন্ত্রীর এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে, তাদের বের করে দেওয়া হয়েছে।’

প্রেসিডেন্ট রামাফোসা আরও বলেন, ‘আমার সরকারের ওপর ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করার দায়িত্ব রয়েছে। কারণ, তারা (ফিলিস্তিনি) একটি ভিন্ন এবং বিশেষ ধরনের জনগণ, যাদের আমরা একটি দেশ হিসেবে সমর্থন করেছি।’

এ বিষয়ে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা তৃতীয় একটি দেশ থেকে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে পাঠানোর অনুমোদন হাতে পেয়েছে, তবে তারা ওই তৃতীয় দেশ কারা, সেটা উল্লেখ করেনি।

এমন এক সময়ে ফিলিস্তিনিদের ফ্লাইট দক্ষিণ আফ্রিকায় নেমেছে, যখন দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। ২২ ও ২৩ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় বসতে চলেছে জি-২০ সম্মেলন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনিদের সরব সমর্থকদের অন্যতম দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু দেশটিতে অবতরণের পর ফিলিস্তিনিদের যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা নিয়ে স্থানীয় অনেকে সমালোচনা করছেন।

অভিযোগ উঠেছে, দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার গত সপ্তাহে দ্বিতীয় ফ্লাইটটি গ্রহণের সময় সঠিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ওই ফ্লাইটে থাকা ১৫৩ ফিলিস্তিনি অন্তত ১০ ঘণ্টা বিমানের ভেতরে অপেক্ষা করতে বাধ্য হন।

দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলার ধারণা, এই কর্মকাণ্ডের পেছনে ইসরাইলের হাত রয়েছে। তিনি একে গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা হিসেবে বর্ণনা করেন।

প্রয়োজনীয় নথিপত্র না থাকায় এসব ফিলিস্তিনির বিষয়ে অভিবাসনসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত তাদের বিমান থেকে নামতে দেওয়া হয়নি।

বিমানে আসা ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজকর্মী নাঈম জিনাহ।

তিনি বলেন, এসব মানুষ গাজা থেকে এসেছেন এবং সেখানে একটি মানবিক সংকট চলছে—ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে ইচ্ছুকই ছিলেন না।

নাঈম জিনাহ আরও বলেন, ‘তারা খুব সংকীর্ণ মন নিয়ে বিষয়গুলো দেখছিলেন।’ তবে শেহাদাদের এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়নি। ২০১৪ সাল থেকে জাতিসংঘের একটি সংস্থায় কাজ করেছেন তিনি।

নাঈম জিনাহ বলেন, ‘তাদের ফ্লাইট ২৮ অক্টোবর দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছায়। অন্য আন্তর্জাতিক যাত্রীরা যেভাবে ইমিগ্রেশন পার হয়েছেন, আমাদের বিমানে থাকা সবাই একইভাবে পার হয়েছি।’

শেহাদা আরও বলেন, গাজা যুদ্ধের সময় তাকে এবং তার পরিবারকে ১২ বার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে।

এক সহকর্মী শেহাদাকে আল-মাজদের ওয়েবসাইটের লিংক পাঠালে গত মার্চে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

শেহাদা ওয়েবসাইটে একটি ফরম পূরণ করেন এবং এক মাস পর এপ্রিলে আল-মাজদ থেকে এক ব্যক্তি তাকে ফোন করেন।

কয়েক মাস পর শেহাদা যখন গাজা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন, তিনি ৬ হাজার ৪০০ ডলার জমা দেন। ২৬ অক্টোবর মধ্যরাতের ঠিক আগে একটি ফোন পান আহমেদ শেহাদা। আল-মাজদ প্রতিনিধি তাদের চার ঘণ্টার মধ্যে খান ইউনিসে পৌঁছাতে বলেন। পরিবার নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়েন শেহাদা।

এ বিষয়ে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা তৃতীয় একটি দেশ থেকে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে পাঠানোর অনুমোদন হাতে পেয়েছে।

শেহাদা বলেন, খান ইউনিসে তাদের একটি বাসে ওঠানো হয়। তাদের বলা হয়েছিল, রাফায় প্রবেশের আগে বাসের জানালায় পর্দা না সরাতে এবং ফোন বন্ধ রাখতে।

আল-মাজদ থেকে তাদের বলে দেওয়া হয়েছিল, যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, তারা কী করছেন, তাহলে বলতে হবে, ফরাসি দূতাবাস গাজা থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার যে কার্যক্রম চালাচ্ছে, তারা তারই অংশ।

যে সময়ের উদ্বেগ আর আতঙ্কের কথা মনে করে এখনো কেঁপে ওঠেন আহমেদ শেহাদা। তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলাম, যদি তাদের ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকে এবং আমরা রাফায় ঢোকার পর যদি ইসরাইলি বাহিনী বাস লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে, তখন কী হবে?’

শেহাদাদের নিয়ে বাসগুলো কেরেম শালোম সীমান্তে পৌঁছায়। সেখানে ইসরাইলি সেনারা তাদের সবসামগ্রী ছেড়ে যেতে বলেছিলেন। তারপর তারা কয়েকটি নিরাপত্তা চেকপোস্ট অতিক্রম করে নতুন বাসে ওঠেন, যা তাদের দক্ষিণ ইসরাইলের রামন বিমানবন্দর পৌঁছে দেয়। সেখানে তারা একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে চড়েন। ফ্লাইটের আকাশে মাঝপথ পর্যন্তও তারা জানতেন না, তাদের গন্তব্য কেনিয়ার নাইরোবি।

নাইরোবি থেকে তারা দক্ষিণ আফ্রিকার পথে উড়াল দেন। শেহাদা বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে তিনি আল-মাজদ ইউরোপ থেকে শেষ বার্তাটি পান। সেই বার্তায় তাকে তার জন্য ‘বুক’ করে রাখা একটি গেস্টহাউসের ঠিকানা জানানো হয়। বলা হয়, এক সপ্তাহের জন্য সেটি তারা বুক করে দিয়েছে। যদিও কথা ছিল এক মাস থাকার ব্যবস্থা করা হবে।

সোমবারও আল-মাজদের ওয়েবসাইটে ঢুকে একটি বার্তা দেখা গেছে। সেখানে বলা হয়েছে, তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে এবং সেবাদান অব্যাহত আছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির নাম ব্যবহার করে অনলাইনে প্রতারণার বিষয়েও সতর্ক করা হয়েছে।

ওয়েবসাইটে থাকা নম্বরে ফোন দিয়ে এবং বার্তা পাঠিয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

সাইফ নামের আরেক ফিলিস্তিনি বলেন, আল-মাজদ তাদের কীভাবে এবং কোথায় পৌঁছে দেবে, সে বিষয়ে তাদের কিছুই জানানো হয়নি।
সাইফ বলেন, ‘আমরা এমনকি এটাও জানতাম না যে আমরা কোথায় যাচ্ছি।’

শেহাদাদের দলটি দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছানোর পর স্থানীয় একটি ত্রাণ সংস্থা পুরো দলের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এ ছাড়া ভিসা ছাড়াই ৯০ দিনের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশের অনুমতির ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা বিশেষ এই সুবিধা রেখেছে।

শেহাদা বলেন, ‘তার চার বছরের মেয়ে জীবনে কেবল যুদ্ধ দেখে বড় হয়েছে। তাই দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে সে যখন দেখছে, দোকানে গিয়ে খাবার কেনা যায় বা ফোনে চার্জ দেওয়া যায়, সে খুবই অবাক হয়ে যাচ্ছে। এ সবকিছুই তার জন্য নতুন, জীবনে এসব বিলাসিতা ছোট্ট শিশুটি শুধু অনলাইনে দেখেছে।’

মেয়ের এই অবাক হওয়া বাবা শেহাদার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে প্রতিদিনই আমাকে বলে, বাবা আমরা ইউটিউবের ভেতরের জীবনের মতো জীবন পেয়ে গেছি।’

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তদন্ত রিপোর্ট: পিলখানা হত্যাকাণ্ডে জড়িত হাসিনাসহ ভারতীয়রা

1

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপির প্রতিনিধ

2

বিএনপির দপ্তরে মনোনয়নবঞ্চিতদের অভিযোগ, তৃণমূলে অস্থিরতা চরমে

3

দলীয় নেতাকর্মীদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মির্জা ফখরুলের আবেগঘন পোস্

4

গণভোটসহ ৫ দফা দাবিতে জামায়াতসহ ৮ দলের দেশব্যাপী বিক্ষোভ সোমব

5

জনগণকে বোকা বানাবেন না: মির্জা ফখরুল

6

বিএনপিতে নমিনেশন পরিবর্তনের হিড়িক!

7

আন্দোলনের মুখে বাড়িভাড়া ভাতা বাড়লো শিক্ষকদের

8

টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মেহজাবীনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়া

9

প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির মামলায় হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে রায

10

রাজপথে দাঁড়াতেই পারেনি ফ্যাসিবাদীরা: গোলাম পরওয়ার

11

এইচএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের ফল ১৬ নভেম্বর

12

ভালুকায় পিকআপসহ ৪৮০ বোতল বিদেশি মদ জব্দ, আটক ১

13

তারেক রহমানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে সরকার: স্বরাষ্

14

বাড়িতে ককটেল বিস্ফোরণ, যা বললেন ডাকসু নেত্রী রাফিয়া

15

গিজার ব্যবহারের সময় খরচ নিয়ন্ত্রণের উপায়

16

মালয়েশিয়ায় ১৮৪ অবৈধ অভিবাসী আটক, আছে বাংলাদেশিও

17

কড়াইল বস্তিতে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ১১ ইউনিট

18

বাংলাদেশি ক্রুসহ অবৈধ জ্বালানি ট্যাংকার আটক করেছে ইরান

19

চুয়াডাঙ্গায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা, দুই বন্ধ

20
সর্বশেষ সব খবর