নিজস্ব প্রতিবেদক: আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর থেকেই সারা দেশে শুরু হয়েছে নজিরবিহীন অস্থিরতা। দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে বিতর্কিত, জনবিচ্ছিন্ন এবং ‘সিন্ডিকেট-নির্ভর’ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগে ক্ষোভে ফুঁসছে তৃণমূল। কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বরিশাল, কুমিল্লা ও মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিয়ত আসছে বিক্ষোভ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং গণপদত্যাগের হুমকি।
মাঠপর্যায়ের তীব্র চাপ এবং বিদ্রোহী প্রার্থীর হুমকির মুখে হাইকমান্ডকে বেশ কিছু আসনে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। বিশেষ করে মাদারীপুর-১ আসনে প্রতিবাদের মুখে প্রার্থী পরিবর্তনের ঘটনা সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে—এখন অন্য এলাকার বঞ্চিতরাও ভাবছেন, চাপ প্রয়োগ করলেই মিলবে নমিনেশন। ফলে সারা দেশে প্রার্থী পরিবর্তনের এক প্রকার ‘হিড়িক’ পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
নিচে জেলা ও বিভাগভিত্তিক অনুসন্ধানী চিত্র তুলে ধরা হলো:
কিশোরগঞ্জ: ভৈরবকে জেলা করার স্বার্থে সদরে ‘পকেট ম্যান’?
মনোনয়ন বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোরগঞ্জ-১ (সদর-হোসেনপুর) আসন। এখানে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. মাজহারুল ইসলামকে মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকেই তোলপাড় চলছে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, মাজহারুল ইসলাম এতটাই জনবিচ্ছিন্ন যে, স্থানীয় পৌর নির্বাচনে কাউন্সিলর হওয়ার যোগ্যতাও তার নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই মনোনয়নের পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন কিশোরগঞ্জ-৬ (ভৈরব-কুলিয়ারচর) আসনের প্রভাবশালী নেতা ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শরীফুল আলম। অভিযোগ রয়েছে, মাজহারুল ইসলাম মূলত শরীফুল আলমের ‘পকেট ম্যান’।
রাজনীতির অন্দরমহলের খবর, শরীফুল আলমের দীর্ঘদিনের এজেন্ডা হলো ভৈরবকে আলাদা জেলা করা। কিন্তু কিশোরগঞ্জ সদর আসনের এমপিরা ঐতিহ্যগতভাবেই জেলা ভাগ করার বিরোধিতা করে থাকেন। তাই সদরের এমপি যদি শক্তিশালী কেউ হন, তবে ভৈরবকে জেলা করা কঠিন হবে। এই সমীকরণ থেকেই শরীফুল আলম সুকৌশলে সদরে এমন একজন দুর্বল, অযোগ্য ও অনুগত প্রার্থী (মাজহারুল) দাঁড় করিয়েছেন, যিনি এমপি হলে ভৈরবকে জেলা করার প্রক্রিয়ায় কোনো বাধা দেবেন না; বরং শরীফুলের ইশারায় চলবেন। নিজের আঞ্চলিক ফায়দা লুটতেই তিনি সদরের রাজনীতিকে বলি দিয়েছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
এই ‘নীল নকশা’ বুঝতে পেরে কিশোরগঞ্জ সদরের ৫ শীর্ষ নেতা—রেজাউল করিম খান চুন্নু, ভিপি সোহেল, মাসুদ হিলালী, রুহুল আমিন ও অ্যাডভোকেট শরীফুল ইসলাম একাট্টা হয়েছেন। তারা সাফ জানিয়েছেন, অন্য উপজেলার নেতার স্বার্থ হাসিলের জন্য সদরে কোনো অযোগ্য ‘পাপেট’ প্রার্থী মেনে নেওয়া হবে না।
টাঙ্গাইল: পরিবারতন্ত্র ও বহিরাগত ইস্যু
টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে ‘পরিবারতন্ত্র’ ও ‘বহিরাগত’ ইস্যুতে আগুন জ্বলছে। টাঙ্গাইল-২ আসনে আব্দুস ছালাম পিন্টু এবং টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে তার ভাই সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে মনোনয়ন দেওয়ায় স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ। একই পরিবারে দুই ভাইর মনোনয়নকে কর্মীরা ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ ও সিন্ডিকেটের ফল হিসেবে দেখছেন।
বিশেষ করে সদর আসনে ত্যাগী নেতা ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবালকে বাদ দিয়ে টুকুকে মনোনয়ন দেওয়ায় সেখানে মশাল মিছিল ও টুকুকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, টুকু মূলত এই আসনের ভোটারদের কাছে ‘বহিরাগত’।
বরিশাল ও মাদারীপুর: পরিবর্তনের ঢেউ ও হেভিওয়েট বনাম নিষ্ক্রিয়
মাদারীপুর-১ আসনে তুমুল আন্দোলনের মুখে কামাল জামান মোল্লার মনোনয়ন বাতিল করে নাদিরা আক্তারকে দেওয়ায় অন্য এলাকার বিদ্রোহীরা উৎসাহিত হয়েছেন। এটি প্রমাণ করেছে যে, চাপ থাকলে হাইকমান্ড নতি স্বীকার করে।
অন্যদিকে, বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনে দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও হেভিওয়েট নেতা জয়নুল আবেদীনকে বাদ দিয়ে গত ১৭ বছর ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা শহিদুল আলম তালুকদারকে মনোনয়ন দেওয়ায় জয়নুল আবেদীনের সমর্থকরা ঝাড়ু মিছিল ও বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন। তাদের প্রশ্ন, দলের দুঃসময়ে যারা পালিয়ে ছিল, সুসময়ে তারা কীভাবে ধানের শীষ পায়?
কুমিল্লা ও অন্যান্য: রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও আল্টিমেটাম
মনোনয়ন কোন্দল এখন আর শুধু মিছিলে সীমাবদ্ধ নেই, কুমিল্লা-৯ (লাকসাম) আসনে মনোনয়নবঞ্চিত নেত্রী সামিরা আজিম দোলার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে, যা পরিস্থিতিকে সহিংস করে তুলেছে। এছাড়া কুমিল্লা-১০ আসনে বিতর্কিত আব্দুল গফুর ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে এবং চাঁদপুর-১ আসনে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনকে পুনর্বহালের দাবিতে তুমুল আন্দোলন চলছে। শেরপুর-১ আসনেও ঝাড়ু মিছিলের মাধ্যমে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি জানানো হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘ দেড় যুগ পর ক্ষমতায় যাওয়ার যে সুযোগ বিএনপির সামনে এসেছে, তা এই ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ ও ‘সিন্ডিকেট রাজনীতি’র কারণে নস্যাৎ হতে পারে। এখন দেখার বিষয়, বিএনপি হাইকমান্ড তৃণমূলের এই বিদ্রোহ আমলে নিয়ে প্রার্থী তালিকায় বড় কোনো পরিবর্তন আনে কি না।
এম.এম/সকালবেলা
মন্তব্য করুন