রাজধানীর ঐতিহাসিক ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই মারামারির ঘটনা ঘটত, যা কখনও কখনও ব্যাপক সংঘর্ষে রূপ নিত। এই ধারাবাহিক সহিংসতা থামাতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেমন বেগ পেতে হতো, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতো এবং সাধারণ পথচারী ও ব্যবসায়ীরাও ভোগান্তিতে পড়তেন।
অবশেষে এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সমঝোতা ফিরিয়ে আনতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম মাহফুজুল হক এক অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারই অংশ হিসেবে একটি 'শান্তিচুক্তি' অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা একে অন্যকে ফুল দিয়ে এবং কোলাকুলি করে নিজেদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতার অবসান ঘটান। তবে এই শান্তিচুক্তি অনুষ্ঠানে সিটি কলেজের কোনো প্রতিনিধি যোগ দেননি।
রবিবার (৯ নভেম্বর) বেলা পৌনে ১২টায় ঢাকা কলেজের অডিটোরিয়ামে এই শান্তি চুক্তি অনুষ্ঠান হয়। এ সময় দুই কলেজের প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর পাশাপাশি নিউমার্কেট থানার ওসি এ কে এম মাহফুজুল হক, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস, আইডিয়াল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ রেযওয়ানুল হকসহ কলেজ দুটির অন্যান্য শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
শান্তি চুক্তি অনুষ্ঠানের শুরুতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের গোলাপ ও রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। এই সময় দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি করেন এবং সেখানে এক উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়। পরে আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের আনা মিষ্টি ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করেন।
ঢাকা কলেজের দ্বাদশ বর্ষের শিক্ষার্থী ইস্রাফিল মোহিম বলেন, "বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে বারবার মুখোমুখি অবস্থানে গেছে। আমাদের দুই কলেজের সহপাঠীদের এই মুখোমুখি অবস্থানকে সুসম্পর্কে উন্নীত করার জন্য শিক্ষকরা এই মেলবন্ধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। আমরা এখন থেকে ভাই ভাই। আমরা কোনো ধরনের ঝগড়ায় না জড়িয়ে এখন থেকে পড়াশোনা করে দেশ গঠনে মিলেমিশে কাজ করব।"
আইডিয়াল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তৌফিক আহম্মেদ ফাহিম বলেন, "আমাদের দীর্ঘদিনের দুঃসম্পর্ক আজ থেকে সুসম্পর্কে পরিণত হলো। কিছু ভুল-ভ্রান্তি থেকে আমাদের মধ্যে ঝামেলা ছিল। এখন থেকে আমাদের এই মেলবন্ধন আজীবন থাকবে, যাতে আমরা আমাদের শিক্ষকদের মান উঁচু করতে পারি। আমাদের মধ্যে কম্পিটিশন থাকবে, তবে তা পড়াশোনা ও ফলাফলের দিক দিয়ে।"
আইডিয়াল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ রেযওয়ানুল হক শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, "তিন কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে মারামারির জন্য একে অন্যকে দায়ী করে। আসলে এর জন্য দায়ী হলো মোবাইল ফোন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক কলেজের শিক্ষার্থীরা অন্য কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ট্রল করে, যা নিয়ে ঝামেলার সূত্রপাত হয়। তাই খারাপ দিক বাদ দিয়ে মোবাইল ফোনের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে, খারাপভাবে ব্যবহার করা যাবে না। আজকের এই মিলন যেন অব্যাহত থাকে।" এ সময় তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষকে আইডিয়াল কলেজের বিরুদ্ধে করা একটি মামলা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান।
ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস এই দিনটিকে অত্যন্ত আনন্দের বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আমরা তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে আন্দোলন করতে দেখেছি এবং পরে তাদের ত্রাণ দিতে দেখেছি। কিন্তু পরবর্তীতে আবার তাদের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়, যার কারণে যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল। তিনি বলেন, "এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। তাই নিউমার্কেট থানার ওসি এই উদ্যোগ নিয়েছেন।" তিনি আরও বলেন, "আমরা সম্প্রীতি বজায় রাখতে চাই। আগামী দিনে আমাদের মধ্যে যেন আর কোনো বিরোধ না ঘটে, সেই প্রত্যাশা রাখি। যেহেতু এখন বিরোধের অবসান ঘটেছে, তাই ওসি সাহেবকে মামলাটি নিষ্পত্তি করার অনুরোধ জানাচ্ছি।"
ওসি মাহফুজুল হক বলেন, তিনি নিউমার্কেট থানায় যোগদানের পর দেখেছেন এই তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায়ই মারামারি হয়। তিনি বলেন, "কী কারণে মারামারি হয়, সেটা তারাও জানে না। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এসব মারামারির ঘটনা ঘটে। পরে তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম, তারা নিজেরা সমঝোতা করতে রাজি। তাই আজকের এই আয়োজন। আমি আশা করি, এই মেলবন্ধন বজায় থাকবে।"
মারুফ/সকালবেলা
মন্তব্য করুন