গণভোট এবং জুলাই জাতীয় সনদ ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ দেখা দিয়েছে। দুই দলের সিনিয়র নেতারা তির্যক ভাষায় একে অপরকে নিশানা বানাচ্ছেন। অপরদিকে সংস্কার ইস্যুতে এনসিপি নেতারা বড় দুই দলের ভূমিকা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করছেন। এছাড়া দল তিনটি সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা অব্যাহত রেখেছে।
এ অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচনের বড় শক্তি হিসাবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার সৃষ্ট বিরোধ সামাল দিতে সরকারের তরফ থেকে পর্দার আড়ালে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সূত্রমতে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে চারজন উপদেষ্টা ইতোমধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে দুই দফা কথা বলেছেন। তবে এখন পর্যন্ত সমঝোতার কোনো ইঙ্গিত মেলেনি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি এক বক্তৃতায় বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন পুরো জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দলটি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট চায়। অপরদিকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ শনিবার যুগান্তরকে জানান, সরকারের উপদেষ্টারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু নির্বাচনের দিন গণভোট তারা মানবেন না। অবশ্যই গণভোট আগে হতে হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) আগে গণভোট চায়।
২৮ অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেওয়ার পরপরই দলগুলোর এরকম অবস্থান প্রকাশ্যে আসে। এক দল অন্য দলের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বক্তব্য দিচ্ছে। তবে সূত্র জানায়, সমঝোতার ক্ষেত্রে সরকার দুটি প্রস্তাব সামনে রেখে আলোচনা শুরু করেছে। এর মধ্যে একটি হলো-বিএনপিকে পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন মেনে নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। অপর প্রস্তাবে জামায়াতকে বলা হচ্ছে, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট মেনে নিতে। কিন্তু উভয় পক্ষই এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে তাদের অবস্থানে অনড়।
এ অবস্থায় বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে যোগাযোগ করবে সরকার। এছাড়া ঐকমত্য কমিশন বলছে, রাজনৈতিক দলগুলো যেসব বক্তব্য দিচ্ছে, এর অধিকাংশই সত্য নয়। কিন্তু এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে দলগুলোর সঙ্গে তারা বিরোধে যেতে চান না। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো যুগান্তরকে এমনটি জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, গণভোট ও জুলাই সনদ ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে এরকম মুখোমুখি অবস্থানে সরকার বিব্রত। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধ মেটাতে পর্দার আড়ালে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকেও এ ব্যাপারে আলোচনা হয়। বিষয়টি সমাধানে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে চারজন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এবং জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। সমঝোতার পর জুলাই সনদ বাস্তবায়নসংক্রান্ত আদেশ জারি হতে পারে।
সূত্র আরও জানায়, সমঝোতার জন্য উপদেষ্টা পরিষদ কয়েকটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে। প্রথমত, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক না করে আগামী সংসদের সংবিধান সংস্কার পরিষদের ওপর ছেড়ে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একদিনে আয়োজনের পক্ষে। তৃতীয়ত, জুলাই সনদে প্রধান উপদেষ্টার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে আদেশ জারি করা। তবে এখন পর্যন্ত এসব বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। উপদেষ্টা পরিষদ মনে করে, ঢাকায় বিএনপির যে নেতৃত্ব রয়েছে, তারা বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এজন্য লন্ডন থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্মতি লাগবে। তাই প্রধান উপদেষ্টাকে তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ থাকলে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। তিনি এ সময়ে দলগুলোকে বিরোধ মেটাতে অনুরোধ করেন।