শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকালে বাংলাদেশে অনুভূত হওয়া শক্তিশালী ভূমিকম্পে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে কোটি মানুষের মনে। পুরান ঢাকায় ভবনের রেলিং ধসে তিনজন ও নারায়ণগঞ্জে দেয়াল ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তুরষ্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ৭.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প ও আফটারশকের কারণে নিহতের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ভূমিকম্পের এই ভয়াবহ চিত্র দেখে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশও আবার চিন্তিত হয়ে উঠেছে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে স্বল্প ও মাঝারি মাত্রার বেশ কিছু ভূমিকম্প হলেও তাতে দৃশ্যমান ক্ষয়ক্ষতি ঘটেনি। তবে ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থান হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা বারবারই সতর্কবার্তা দিচ্ছেন দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। নিকট অতীতে বাংলাদেশে কোনো ভয়াবহ ভূমকম্পনের স্মৃতি না থাকলেও দেশের কয়েকশো বছরের ইতিহাসে রয়েছে বেশ কিছু বিধ্বংসী ভূমিকম্পের তালিকা।
বিগত শতকগুলোর কিছু বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সময়কাল ও বর্ণনা বিভিন্ন নথি ঘেঁটে নিচে তুলে ধরা হলো:
১৫৪৮ সাল: বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আঘাত হানা প্রথম বড় ধরনের ভূমিকম্প। এর ফলে চট্টগ্রাম ও সিলেটের অবস্থানে নানা জায়গায় মাটি ফেটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় এবং দুর্গন্ধযুক্ত কাদা-পানি বেরোনোর তথ্য পাওয়া যায়। তবে হতাহতের কোনো তথ্য লিপিবদ্ধ হয়নি।
১৬৪২ সাল: এক শক্তিশালী ভূমিকম্পে সিলেট জেলার অনেক দালান-কোঠা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে সেবারও মানুষের প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি।
১৭৬২ সালের এপ্রিল মাস (বাংলাদেশের অন্যতম বড় ভূমিকম্প): ১৯০৮ সালের 'ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গ্যাজেটিয়ার চিটাগাং'-এর তথ্য অনুযায়ী, এই ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম জেলার অনেক জায়গায় মাটি ফেটে প্রচুর পরিমাণে কাদা-পানি ছিটকে বেরোয়। 'পর্দাবন' নামক জায়গায় একটি বড় নদী শুকিয়ে যায়। 'বাকর চনক' নামের এক অঞ্চলের প্রায় ২০০ মানুষ তাদের গৃহপালিত প্রাণীসহ পুরোপুরি নিমজ্জিত হয় সমুদ্রগর্ভে। ভূমিকম্পের প্রভাবে ভূখণ্ডের বিভিন্ন জায়গায় সৃষ্টি হয় অতল গহ্বরের।চট্টগ্রাম ও ঢাকা: ১৭৬২ সালের এই ভূমিকম্পে চট্টগ্রামে প্রায় ৫০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৯১২ সালের 'ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গ্যাজেটিয়ার ঢাকা'-এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বিভিন্ন নদী আর ঝিলের পানিতে প্রবল আলোড়ন দেখা যায়, পানির স্তর উঁচু হয়ে যায় এবং অসংখ্য মরা মাছ ছড়িয়ে ছিল জলাশয়ের পাড়ে। ভূপৃষ্ঠের প্রবল আলোড়নের পাশাপাশি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ভূগর্ভস্থ শব্দ।
১৮৮৫ সাল ('বেঙ্গল আর্থকোয়েক'): মানিকগঞ্জে আঘাত হানা এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল প্রায় ৭। এর সম্ভাব্য উপকেন্দ্র ছিল ঢাকার ১৭০ কিলোমিটার দূরবর্তী সাটুরিয়ার কোদালিয়ায়। কম্পন ভারতের বিহার, সিকিম, মণিপুর ও মিয়ানমারেও অনুভূত হয়েছিল। ঢাকা, ময়নমনসিংহ, শেরপুর, পাবনা, সিরাজগঞ্জের অনেক দালানকোঠা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
১৮৯৭ সালের ১২ জুন ('দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক'): এটি বিধ্বংসী ভূমিকম্প হিসেবে পরিচিত, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ধারণা করা হয় প্রায় ৮।ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি: ১৯২৩ সালের 'বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গ্যাজেটিয়ার পাবনা'য় বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী, এই ভূমিকম্পে সিরাজগঞ্জে উপবিভাগীয় অফিসের উপরের তলা, কারাগার, ডাকঘরসহ নানা স্থাপনা ধ্বংস হয়। পাবনার কোর্ট হাউজসহ অন্যান্য ইটের স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাপিডিয়া-র তথ্য অনুযায়ী, শুধু সিলেট জেলাতেই মৃতের সংখ্যা ছিল ৫৪৫। ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়। তখনকার হিসাবে শুধু অর্থ-সম্পত্তির ক্ষতিই হয়েছিল প্রায় ৫০ লাখ টাকা।
১৯১৮ সাল ('শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প'): প্রায় ৭.৬ মাত্রার এই ভূমিকম্পে শ্রীমঙ্গলের অনেক দালান-কোঠা ধ্বংস হয়েছিল। এটি মিয়ানমার ও ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলেও অনুভূত হয়।
১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট ('আসাম ভূমিকম্প'): বিংশ শতকের অন্যতম ভয়ানক এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮.৭। বাংলাদেশের নানান অঞ্চলে এটি অনুভূত হলেও তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি দেশে।
১৯৯৯ সালের জুলাই মাস ('মহেশখালী ভূমিকম্প'): বিংশ শতকে বাংলাদেশের শেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্পটি হয় মহেশখালী দ্বীপে, যার মাত্রা ছিল ৫.২। এতে দ্বীপের অনেক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মারুফ/সকালবেলা
মন্তব্য করুন