২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গেছে এক নজিরবিহীন পাসের ধস। গত বছর যেখানে পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ, সেখানে এবার তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ- যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। ফলে শিক্ষা অঙ্গনে শুরু হয়েছে তীব্র আলোচনা ও বিশ্লেষণ।
শিক্ষার্থীদের হতাশা, অভিভাবকদের উদ্বেগ এবং শিক্ষাবিদদের সমালোচনার মধ্যেই উঠে এসেছে মূল কারণগুলো, যা ব্যাখ্যা করেছেন ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সকালে ফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।
অধ্যাপক এহসানুল কবির বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার ব্যাপারে অনেকটাই বিমুখ হয়ে গেছে। তারা পড়ার টেবিল থেকে দূরে ছিল, এটাই মূল কারণ।’ তার বক্তব্যে স্পষ্ট, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিয়মিত অধ্যয়ন ও মনোযোগের অভাবই এবারের ফলাফলের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গত কয়েক বছর ধরে অটোপাস, সংক্ষিপ্ত সিলেবাস এবং অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার ফলে শিক্ষার্থীরা বাস্তব পরীক্ষা প্রস্তুতির অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছিল। এবার প্রথমবারের মতো পূর্ণমান, পূর্ণ সময় এবং পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়ায় তারা হঠাৎ চাপের মুখে পড়ে। এতে অনেকেই প্রত্যাশিত ফলাফল করতে পারেনি।
ফলাফলের এই পতনের পর করণীয় বিষয়ে অধ্যাপক এহসানুল কবির বলেন, ‘এই ফল নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষা বোর্ড, সবাইকে বসে আলোচনা করতে হবে। আমরা শিক্ষক ছিলাম, জানি- শিক্ষার্থীদের বোঝানো ও অনুপ্রাণিত করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি জানান, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতভাগ ফেল হয়েছে, তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক ডাকা হবে এবং শিক্ষার্থীদের পুনর্মূল্যায়ন ও পুনরুদ্ধারে বিশেষ কার্যক্রম নেওয়া হবে। অন্যদিকে, যারা ভালো ফল করেছে, তাদের অভিনন্দন জানিয়ে তাদের শিক্ষা পদ্ধতি অন্য প্রতিষ্ঠানের জন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
ফলাফলে ব্যর্থ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অধ্যাপক এহসানুল কবির বলেন,‘যারা ফেল করেছেন, তারা যেন এই ফলকে জীবনের চূড়ান্ত ব্যর্থতা মনে না করেন। এটা কেবল একটি ধাপ, এখান থেকেই ফিরে আসা সম্ভব।’ তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আহ্বান জানান, যেন তারা ফেল করা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায় এবং তাদের পুনরায় প্রস্তুত হতে সহায়তা করে।
ফলাফল নিয়ে ‘ভালো না খারাপ’ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক কবির বলেন, ‘আমি এটিকে খারাপ বলব না, বরং এটি আমাদের শিক্ষার বাস্তব চিত্র। গত কয়েক বছর ধরে আমরা যে কৃত্রিমভাবে ভালো ফলাফলের ধারায় ছিলাম, তা এবার বাস্তবে ফিরে এসেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীর মতো জায়গায়ও এবার ফেল করেছে ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়- এটি সার্বিক বাস্তবতা। আমরা ফলাফল বাড়াতে কোনো বাড়তি সুবিধা বা নম্বর দিইনি; সবকিছু নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছে।’
শিক্ষাবিদেরা মনে করছেন, করোনা-পরবর্তী শিক্ষার ধারা, পরীক্ষার কাঠামোগত পরিবর্তন, শিক্ষক সংকট এবং শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাসে পরিবর্তন, সব মিলিয়ে এই ফলাফলের ধস অনিবার্য ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা কয়েক বছর ধরে শিক্ষার্থীদের মৌলিক প্রস্তুতি কমিয়ে এনে ফলাফল বাড়াচ্ছিলাম। এবার বাস্তবতা আমাদের সামনে এসেছে।’
২০২৫ সালের এইচএসসি ফলাফল শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব মূল্যায়ন। শিক্ষার্থীদের বিমুখতা, শিক্ষকদের সীমাবদ্ধতা এবং শিক্ষা নীতির অস্থিরতা-সবকিছু মিলিয়ে এই ধস আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। শিক্ষা বোর্ডের কর্তা ও বিশেষজ্ঞরা একমত, এখন সময় আত্মসমালোচনার, সময় শিক্ষার মান উন্নয়নের বাস্তব উদ্যোগ নেওয়ার। শুধু পাসের হার নয়, শেখার মানই এখন হওয়া উচিত শিক্ষানীতির প্রধান লক্ষ্য।
সকালবেলা/এমএইচ
মন্তব্য করুন