
দেশের বিচারব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও গতিশীল করার লক্ষ্যে সব জেলায় পৃথক বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ নির্দেশনা জারি করা হয়। এই সিদ্ধান্তকে দেশের বিচারিক ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশের প্রতিটি জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বর্তমানে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটরা আমলি আদালতের বিভিন্ন দায়িত্ব যেমন অপরাধ আমলে গ্রহণ, পুলিশ তদন্ত তদারকি, জামিন শুনানি, রিমান্ড শুনানি, এবং বিশেষ আইনের অধীনে সামারি কোর্ট পরিচালনা করেন। পাশাপাশি তারা এফিডেভিট সম্পাদনাসহ নানা প্রশাসনিক কাজেও সম্পৃক্ত থাকেন। তবে এসব বহুমুখী দায়িত্ব পালনের ফলে বিচারিক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময় বরাদ্দ করা সম্ভব হয় না। এ কারণে আদালতের মামলাজট বাড়ছে এবং বিচারপ্রার্থীরা দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ‘আমলি আদালতের কর্মব্যস্ততার কারণে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটরা দৈনিক কর্মঘণ্টার মধ্যে তাদের বিচারিক কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারছেন না। এজন্য বিচার প্রক্রিয়ার গতি বাড়াতে এবং বিচারিক কার্যক্রমে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সব জেলায় পৃথক বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গঠন করা অত্যাবশ্যক।’
নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি জেলায় বিদ্যমান ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মধ্যে কিছু আদালতকে শুধুমাত্র বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং অন্য কিছু আদালতকে শুধুমাত্র আমলি আদালত হিসেবে নির্ধারণ করা হবে। এর মাধ্যমে বিচারকরা তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্বের ওপর মনোযোগ দিতে পারবেন এবং মামলার নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা রোধ, বিচারপ্রাপ্তিতে জনগণের আস্থা বৃদ্ধি এবং বিচার বিভাগের কর্মদক্ষতা উন্নত করা সম্ভব হবে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশের বিচার সংস্কারের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের কাজ ও দায়িত্ব আলাদা করে দেওয়া হলে তারা আরও মনোযোগীভাবে বিচার পরিচালনা করতে পারবেন, যা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে বহু মামলা বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। বিচারক সংকট, আদালতের সীমিত অবকাঠামো, এবং প্রশাসনিক জটিলতার কারণে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া দীর্ঘ হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে পৃথক বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গঠন করলে প্রতিটি ম্যাজিস্ট্রেট নির্দিষ্ট ধরনের মামলার ওপর ফোকাস করতে পারবেন। এতে একদিকে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হবে, অন্যদিকে বিচারপ্রার্থীর হয়রানি ও সময়ের অপচয়ও কমবে। সুপ্রিম কোর্টের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই নতুন ব্যবস্থায় বিচারিক ও আমলি কাজের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হবে। ফলে একজন ম্যাজিস্ট্রেট কেবলমাত্র বিচারমূলক কার্যক্রমে মনোনিবেশ করতে পারবেন, আর প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত অন্য ম্যাজিস্ট্রেটরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখবেন।
এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের আইনজীবীরা। তারা মনে করছেন, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের পৃথক দায়িত্ব নির্ধারণের ফলে আদালতের চাপ অনেকটা কমবে এবং বিচার ব্যবস্থায় গতি আসবে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের এক সিনিয়র সদস্য বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই আমরা পৃথক বিচারিক আদালতের দাবি করে আসছিলাম। এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে মামলা নিষ্পত্তির গতি বহুগুণে বাড়বে এবং জনগণের আস্থা আরও দৃঢ় হবে।’
সব জেলায় পৃথক বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গঠন করার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা দেশের বিচার ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সংস্কার। এটি শুধু মামলাজট কমাতে সাহায্য করবে না, বরং বিচারপ্রাপ্তির ন্যায়সংগত ও দ্রুত ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পথও প্রশস্ত করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপ যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশের বিচারিক কাঠামো আরও স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং জনবান্ধব হয়ে উঠবে। দেশের আদালত ব্যবস্থায় এটি হবে একটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তনের সূচনা, যা ভবিষ্যতে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের পথকে আরও সুসংহত করবে।
সকালবেলা/এমএইচ