
ঢাকা শহর দিন দিন আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক নিরাপত্তা ও জরুরি সেবার ডিজিটালীকরণের দিকে এগোচ্ছে। তবে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তৈরি হওয়া মোবাইল অ্যাপ ও হটলাইন সেবাগুলো সব সময় প্রত্যাশিত কার্যকারিতা দেখাতে পারছে না। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক, সাইবার অপরাধ, অস্ত্র-বিস্ফোরক, চোরাচালান, জালিয়াতি এবং নারী নির্যাতন সহ বিভিন্ন ধরনের সন্দেহজনক কার্যক্রম রিপোর্ট করার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কয়েক বছর আগে ‘হ্যালো সিটি’ নামে একটি অ্যাপ চালু করেছিল।
‘হ্যালো সিটি’ অ্যাপটি ২০১৬ সালের ৩১ জুলাই উদ্বোধন করা হয়। এটির মূল উদ্দেশ্য ছিল নাগরিকদের সরাসরি পুলিশি সেবা ও নজরদারিতে যুক্ত করা। নাগরিকরা অ্যাপের মাধ্যমে লেখা বার্তা, ছবি, ভিডিও বা অডিও ফাইল আপলোড করে সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের তথ্য সরাসরি পুলিশকে জানাতে পারতেন। তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটি সিটি সি) দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। অ্যাপটির একটি মূল বৈশিষ্ট্য ছিল তথ্যদাতার পরিচয় গোপন রাখার সুবিধা, যা নাগরিকদের নিরাপদে রিপোর্ট করতে সহায়তা করত। প্রথম এক মাসে প্রায় ২৭৩৭টি অভিযোগ জমা পড়েছিল। তবে বর্তমানে অ্যাপটির কার্যক্রম থমকে আছে। ডিএমপির সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন শিকদার জানিয়েছেন, ‘হ্যালো সিটি অ্যাপটির কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে। ফলে এই অ্যাপের কোনও রিপোর্ট গ্রহণ বা প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে না।’ পুলিশ জানাতে পারেনি অ্যাপটি কবে থেকে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে এবং এ পর্যন্ত মোট কত অভিযোগ জমা পড়েছে। এ তথ্যের অভাবে নাগরিকরা জানে না, তাদের রিপোর্টের কার্যকারিতা কোথায় থেমেছে।
অন্যদিকে, ‘হেল্প অ্যাপ’ চালু হয়েছে ঢাকার গণপরিবহণে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এটি মূলত পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে বছরের ১৫ মার্চ থেকে কার্যক্রম শুরু করেছে। নারীরা যদি চলন্ত বা স্থির গণপরিবহণে যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হন, তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ করতে পারেন। অ্যাপটি ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) ও সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন যৌথভাবে তৈরি করেছে। গুগল প্লে স্টোর থেকে এটি পাঁচ শতাধিক মোবাইলে ইন্সটল করা হয়েছে। অভিযোগ জমা পড়লে তা নিকটস্থ থানায় পাঠানো হয় এবং প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা করে। বিজেসি সূত্রে জানা যায়, পাইলট পর্যায়ে হেল্প অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০টিরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই প্রকল্প এলাকার বাইরের অভিযোগ। এছাড়া ফোন কলও আসে নিয়মিত, তবে অনেকেই ‘ফেক কল’ বা বাইরের কল হয়। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দ্রুত পুলিশের নিকটস্থ থানায় প্রেরণ করা হয় এবং কিছু নারীর মানসিক পুনর্বাসনের জন্য কাউন্সিলিংও করা হয়। বিজেসি কো-অর্ডিনেটর আদনান চৌধুরী জানান, ‘এই অ্যাপটি বর্তমানে ৯টি থানার এলাকায় কার্যকর, যেখানে নারীরা কোনও ধরনের হয়রানির শিকার হলে দ্রুত সহায়তা পাচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য হলো পুরো ঢাকার গণপরিবহণকাউন্সিলিংওকে এই অ্যাপের আওতায় আনা।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিট নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, নিপীড়ন এবং সাইবার হ্যারেজমেন্টের মতো সংবেদনশীল মামলার তদন্ত পরিচালনা করছে। ডিসি ফারহানা ইয়াসমিনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ইউনিটটি মোট ২৫৫টি মামলা তদন্ত করেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগ ১২৬টি, অপহরণের ৪৮টি, শ্লীলতাহানি ২৯টি এবং যৌন হয়রানির ৫২টি মামলা অন্তর্ভুক্ত। ডিএমপির এ বিশেষ ইউনিট নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং যেকোনো ধরনের নির্যাতনের শিকারদের সহায়তা প্রদানে কাজ করছে। ডিসি ফারহানা ইয়াসমিন জানান, ‘আমাদের লক্ষ্য শুধু মামলা তদন্ত করা নয়, বরং শিকার নারীদের মানসিক সহায়তা ও আইনি সহায়তাও প্রদান করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ইউনিটের মাধ্যমে আমরা নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা চিহ্নিত করি এবং দোষীদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করি। এতে সমাজে নারীর নিরাপত্তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।’
একই সময়ে, ১১৫টি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে এবং ৫৩ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। যদিও পুলিশের এই উদ্যোগ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তথাপি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, সামগ্রিক কার্যক্রম এখনও সীমিত।
তারা বলেন, ‘ডিএমপির উদ্যোগ প্রশংসনীয়, তবে আরও প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং সংবেদনশীল তদন্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।’ সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে হয়রানির ঘটনায়, ইউনিটটি দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে।
শিকার নারীরা জানান, পুলিশি সহায়তা পেয়ে তারা অনেকটা সান্ত্বনা পাচ্ছেন এবং আইনের আশ্রয় পাচ্ছেন। এভাবে, ডিএমপির উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের কার্যক্রম নারীর নিরাপত্তা ও আইনি সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ভবিষ্যতে আরও সমন্বিত পদক্ষেপ, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই ইউনিটের কার্যক্রম আরও কার্যকর এবং সম্প্রসারিত হওয়া প্রত্যাশিত।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর চালু হয়। এটি পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং অ্যাম্বুলেন্স সহ তিনটি জরুরি সেবা একত্রে প্রদান করে। সাধারণ মানুষ দুর্ঘটনা, অপরাধ, অগ্নিকাণ্ড বা অসুস্থতার মতো পরিস্থিতিতে এক নম্বরে সহায়তা পেতে পারে। ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ থেকে ৩১ আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত ৬ কোটি ৫৩ লাখ ১৪ হাজার ৮১২টি কল এসেছে। এর মধ্যে ৪৩.৯২% কল সেবা প্রদানযোগ্য, ৫৬.০৮% বিভিন্ন কারণে বাতিল। পুলিশি সহায়তার আবেদন সবচেয়ে বেশি, মোট ২২ লাখ ৮৬ হাজার ১৪৩টি জরুরি কলের মধ্যে ১৯ লাখ ৭ হাজার ৫১২টি পুলিশি সহায়তার জন্য। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, ৯৯৯ সেবা দেশের সাধারণ মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে পুলিশি সহায়তায়।
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ নামে হটলাইন চালু আছে। ফোন নম্বর ০১৩২০০০০৮৮৮, ২৪ ঘণ্টা সক্রিয়। এছাড়া ফেসবুকেও অভিযোগ নেওয়া হয়: facebook.com/pcsw.phq।
২০২৫ সালের ১০ মার্চ থেকে পুলিশের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল কার্যকর। হটলাইন নম্বরগুলো হলো: ০১৩২০০০২০০১, ০১৩২০০০২০০২, ০১৩২০০০২২২২। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, ‘এই হটলাইনগুলো নারীদের আইনি পরামর্শ, থানায় অভিযোগ জমা ও মনিটরিং করার জন্য খোলা থাকে। মূল লক্ষ্য নারী ও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।’
যদিও হ্যালো সিটি ও হেল্প অ্যাপ, ৯৯৯ হটলাইন নারী ও শিশুদের সুরক্ষা এবং সাধারণ নাগরিকদের জরুরি সহায়তা প্রদানে কার্যকর, তবে কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা গেছে: ১. হ্যালো সিটি অ্যাপের কার্যক্রম থমকে যাওয়া: সঠিক সময়ে রিপোর্ট গ্রহণ ও তদন্তে ফাঁক তৈরি হয়েছে। ২. হেল্প অ্যাপ সীমিত পাইলট প্রজেক্ট: শুধুমাত্র বছিলা থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত কার্যকর। পুরো ঢাকা বা অন্যান্য শহরে কার্যক্রম নেই। ৩. জনসচেতনতার অভাব: নাগরিকদের কাছে হটলাইন নম্বর ও অ্যাপ সম্পর্কে সচেতনতা সীমিত। ৪. ফেক কল ও ভুল রিপোর্টিং: জরুরি কল সেবার মধ্যে অনেক ক্র্যাঙ্ক কল বা ফেক কল আসে, যা কার্যকর প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটায়।
ঢাকার নাগরিক নিরাপত্তা ডিজিটালাইজেশনে এগোচ্ছে, তবে কার্যক্রমের অখণ্ডতা ও সম্প্রসারণে সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হ্যালো সিটি, হেল্প অ্যাপ ও ৯৯৯ হটলাইন সেবাগুলো নাগরিক অংশগ্রহণ, দ্রুত সহায়তা ও মানসিক পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে সক্ষম। তবে পূর্ণ কার্যকর করতে হলে সরকারি, বেসরকারি এবং নাগরিক অংশগ্রহণের মধ্যে আরও সমন্বয় দরকার।
ডিজিটাল নিরাপত্তা উদ্যোগগুলো নাগরিকদের জরুরি সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, তাদের কার্যকর ও স্থায়ী করতে হলে প্রযুক্তিগত ত্রুটি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক সহায়তা অপরিহার্য। হ্যালো সিটি ও হেল্প অ্যাপের মতো উদ্ভাবনকে শুধুমাত্র পাইলট পর্যায়ে রাখলে নাগরিকরা প্রয়োজনীয় সহায়তা পান না। ৯৯৯ সেবা দেশের নাগরিকদের আস্থা অর্জন করেছে, কিন্তু অন্যান্য হটলাইন ও অ্যাপের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে সরকারি মনিটরিং, বেসরকারি সহযোগিতা এবং নাগরিক সচেতনতা একযোগে বাড়ানো প্রয়োজন।
এতে সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, সাইবার অপরাধ ও অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতিতে নাগরিকদের জীবন ও নিরাপত্তা আরও সুরক্ষিত হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তার এই ধারা যদি সম্প্রসারিত ও শক্তিশালী হয়, তবে নাগরিকদের বিপদে-আপদে সহায়তা পাওয়া নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। দেশবাসী কেবল সেবার ব্যবহারকারী নয়, বরং এই উদ্যোগের একটি সক্রিয় অংশীদার হয়ে গণঅভিযোগের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করতে সক্ষম হবে।
সকালবেলা/এমএইচ